গ্যাস বিক্রিতে রুবলের শর্ত কেন আনলেন পুতিন

 গ্যাস বিক্রিতে রুবলের শর্ত কেন আনলেন পুতিন 

রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করতে হলে এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে দেশটির মুদ্রা রুবলে। এ জন্য রাশিয়ার একটি ব্যাংকে বিশেষ হিসাব খুলতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলেই গ্যাস সরবরাহ চুক্তি স্থগিত করবে মস্কো। গত বৃহস্পতিবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এ ঘোষণা শুক্রবার (১ এপ্রিল) থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। তবে ইতিমধ্যে জার্মানিসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর সরকার এটিকে ‘রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেইল’ আখ্যায়িত করেছে। পাশাপাশি রাশিয়ার এই দাবি প্রত্যাখ্যানও করেছে। শুক্রবার আল-জাজিরার এক বিশ্লেষণে এ তথ্য জানানো হয়। পরে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রুবলে অর্থ পরিশোধের দাবি নিয়ে সৃষ্ট উত্তেজনার মধ্যে রাশিয়া বলেছে, তারা ইউরোপে গ্যাস রপ্তানি বন্ধ করবে না।

বিজ্ঞাপন

ক্রেমলিন জানায়, যে গ্যাসের জন্য অর্থ পরিশোধ করা আছে তা পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, রুবল নিয়ে কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া না গেলেও ১ এপ্রিল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হচ্ছে না। পুতিনের ডিক্রি জারির সঙ্গে সঙ্গেই তা কার্যকর হচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বলছে, গ্যাসের অর্থ কীভাবে পরিশোধ করা হবে তা নিয়ে গ্যাস কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে।
ইউরোপিয়ান কমিশনের জ্বালানি নিয়ন্ত্রক সংস্থার মহাপরিচালক দিট্টি জুল জর্গেনসেন এক টুইটে বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে গ্যাসের চুক্তিতে অর্থ পরিশোধ কীভাবে করা হবে তা নিয়ে সদস্য দেশ ও গ্যাস কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে ইইউ।

পুতিনের এই নির্দেশের পেছনে কারণ কী

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ব্যাংক, কোম্পানি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর যে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তার সঙ্গে পুতিনের এ সিদ্ধান্তের যোগসূত্র রয়েছে। রাশিয়া মনে করে, এসব নিষেধাজ্ঞা অর্থনৈতিক যুদ্ধের মতো।

পুতিনের নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, গ্যাসের বিদেশি ক্রেতাদের প্রথমে রাশিয়ার গ্যাজপ্রম ব্যাংকে একটি বিশেষ হিসাব খুলতে হবে। তাঁরা ওই হিসাবে বিদেশি মুদ্রা জমা দেবেন। গ্যাজপ্রম ব্যাংক ওই মুদ্রা রুবলে রূপান্তরের পর তা গ্যাসের মূল্য পরিশোধে ব্যবহার করা যাবে।

পুতিন বলেন, ‘কেউ যদি অর্থ পরিশোধ না করে, তবে তাকে খেলাপি হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কেউ বিনামূল্যে আমাদের কাছে কিছু বিক্রি করে না। আর আমরাও দাতব্য কিছু করতে যাচ্ছি না।’

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় রুবলের ভয়াবহ পতন দেখা যায়। তবে রুবলে গ্যাসের মূল্য পরিশোধে পুতিনের নেওয়া সিদ্ধান্তের পর রাশিয়ার মুদ্রার মান ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।

মস্কো তার ‘বন্ধু নয় এমন দেশগুলোর’ কাছে রুবলে গ্যাস বিক্রি করবে– এই ঘোষণার এক সপ্তাহ পর বৃহস্পতিবার এক ডলারের বিপরীতে ৮১.৭ রুবল পাওয়া গেছে; যা ২৩ ফেব্রুয়ারির প্রায় সমান।

চলতি বছর এ পর্যন্ত ইউরোপ প্রতিদিন রাশিয়ার গ্যাসের জন্য ব্যয় করেছে ২০ থেকে ৮০ কোটি ইউরো (৮৮ কোটি মার্কিন ডলার)। যেভাবেই অর্থ পরিশোধ করা হোক না কেন এই বিক্রি ইতিমধ্যেই নিষেধাজ্ঞার প্রভাবকে ব্যাপকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। এর ফলে রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী ও কোষাগার সমৃদ্ধ হচ্ছে। এ ছাড়া এখানে রাজনৈতিক লক্ষ্যও রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোকে মস্কোর কালো তালিকাভুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব নিষেধাজ্ঞাগুলো লঙ্ঘন করতে বাধ্য করা অন্যথা তাদের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার বিষয় রয়েছে।

এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ

ইউরোপ রাশিয়ার জ্বালানি সম্পদের ওপর ব্যাপক নির্ভরশীল। ওই দেশগুলো তাদের চাহিদার ৪০ শতাংশ গ্যাস রাশিয়া থেকে আমদানি করে থাকে। মস্কো যদি এই সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তবে জ্বালানি সংকটে পড়বে ইউরোপ। এর ফলে বন্ধ হয়ে পড়বে তাদের শিল্পকারখানা। অঞ্চলজুড়ে জ্বালানির দাম বাড়তে থাকবে।

এর ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি ও শিল্পসমৃদ্ধ দেশ জার্মানি। যুদ্ধ শুরুর আগে দেশটি রাশিয়া থেকে তাদের চাহিদার ৫৫ শতাংশ গ্যাস আমদানি করত। যদিও চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এর পরিমাণ কমে ৪০ শতাংশে দাঁড়ায়।

জার্মান সরকার এরই মধ্যে তিন ধাপের ‘জরুরি পরিকল্পনা’র প্রথম ধাপ কার্যকর করেছে। যাতে গ্যাস সরবরাহ কমে গেলে গ্যাস রেশনিংয়ের দিকে যেতে পারে তারা। গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতির আশঙ্কায় ইতিমধ্যে নেদারল্যান্ডসে এ বছর গ্যাসের দাম রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।

কোন দেশগুলো সাড়া দিতে পারে বলে ভাবছে রাশিয়া

রাশিয়ার ‘অবন্ধু’ দেশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশ, কানাডা, জাপান, নরওয়ে, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড, ইউক্রেন ও যুক্তরাজ্য রয়েছে। এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়েসহ কয়েকটি দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে গ্যাস কেনে না।

বিদেশি ক্রেতারা কী করবেন

এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে না যে বিদেশি ক্রেতারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করবে। পশ্চিমা দেশগুলো বলেছে, রুবলে অর্থ পরিশোধ করলে চুক্তি লঙ্ঘন হবে। এ নিয়ে পুনরায় আলোচনা করতে কয়েক মাস বা তার বেশি সময় নিতে পারে।

নেদারল্যান্ডসের বহুজাতিক ব্যাংকিং এবং আর্থিক পরিষেবা সংস্থা রাবোব্যাংকের জ্যেষ্ঠ মার্কেট কৌশলবিদ ক্রিস্টিয়ান লরেন্স বলেন, ইউরোপের রুবলে সরাসরি অর্থ পরিশোধ করার খুব বেশি সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, ‘পুতিন বেশ স্পষ্ট করে বলেছেন যে এই গ্যাসের জন্য তাঁর রুবল দরকার। তাই যদি ঘটে, তাহলে আমার ধারণা তিনি তৃতীয় পক্ষের সাহায্য নেবেন।’

বিদেশি ক্রেতারা রাজি হলে কীভাবে কাজ করব

পুতিনের নির্দেশ অনুযায়ী গ্যাজপ্রম ব্যাংক এই গ্যাস বাণিজ্যে মধ্যস্থতা করবে। একজন বিদেশি ক্রেতা এখন গ্যাজপ্রম ব্যাংকে ‘কে’ নামের এক বিশেষ অ্যাকাউন্টে বিদেশি মুদ্রা স্থানান্তর করতে বাধ্য। এরপর গ্যাজপ্রম ব্যাংক ক্রেতার পক্ষ হয়ে ওই রুবল কিনবে এবং তা বিশেষ ‘কে’ নামের আরেক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করবে।

যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রয়েছে গ্যাজপ্রম ব্যাংক। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইফট পেমেন্ট নেটওয়ার্ক থেকে রাশিয়ার যেসব ব্যাংককে নিষিদ্ধ করেছে সেখানে গ্যাজপ্রম ব্যাংক নেই।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্বালানি সম্পর্ক পুরোপুরি বাতিল করার অংশ হিসেবে শিগগিরই গ্যাজপ্রম ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে, এমনটাই ক্রেমলিনের আশঙ্কা।

ভবিষ্যতে কী হবে

ইউরোপীয় ইউনিয়নকে রুবলে গ্যাস কিনতে বাধ্য করতে রাশিয়াকে ইইউতে গ্যাস প্রবাহ আক্ষরিকভাবে বন্ধ করতে হবে। তবে এমনটি করবে কি না তা পরিষ্কার নয়। আর যদি এটি করেও তা একটি বড় ঘটনা হয়ে থাকবে, যা স্নায়ুযুদ্ধের সময়ও রাশিয়া করেনি।

এদিকে ইউরোপীয় কমিশন ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে রুবলে গ্যাসের অর্থ পরিশোধের বিষয়ে মস্কোর অবস্থানের ওপর এই নিষেধাজ্ঞার মাত্রা নির্ভর করবে।

Post a Comment

0 Comments